উন্নত জীবন ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিজ আমিষের গুরুত্ব
ডা: মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা১ ড. হোসেন মো: সেলিম২
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, সুষম পুষ্টি, বেকার সমস্যার সমাধান ও আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কৃষি জমির উর্বরতা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্মৃতিশক্তি বিকশিত মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য খাত হলো প্রাণিসম্পদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সূচিত পথ ধরে তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির টেকসই জাত উন্নয়ন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদন দ্বিগুণ করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষিজ জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬.৫২% এবং জাতীয় দেশজ উৎপাদনে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১.৯০%। জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। দেশের প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৭০-৭৫% আমিষ এ প্রাণিসম্পদ খাত থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। সর্বোপরি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভ্যালু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নিম্নে দেশের আপামর জনগোষ্ঠির উন্নত জীবন যাপনে ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে প্রাণিজ আমিষের অপরিসীম গুরুত্ব উপস্থাপন করা হলো-
দুধের পুষ্টিগুণ : দুধ একটি সম্পূর্ণ ও আদর্শ খাদ্য এবং ইহা উৎকৃষ্ট আমিষের উৎস্য। আয়রন ছাড়া সকল প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলস দুধে বিদ্যমান। দুধে এল-ট্রিপটোফেন নামক এমিনো এসিড থাকে বিধায় দুধ খেলে ভালো ঘুম হয়। দুধ থেকে তৈরি ইউগার্ট প্রবায়োটিক হিসেবে কাজ করে যা হজম শক্তি এবং শরীরের ইমিউন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এক কাপ দুধে প্রায় ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরী শক্তি, ৮-১০ মিলিগ্রাম মানসম্মত ফ্যাট, ৮-১০ মিলিগ্রাম উন্নত প্রোটিন, ১৩-১৫ মিলিগ্রাম শর্করা, ২৪-২৫ মিলিগ্রাম ঝুঁকিবিহীন কোলেস্টেরল, ৯৮-১০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে।
ডিমের পুষ্টিগুণ : ডিম একটি সম্পূর্ণ নিউট্রিয়েন্ট পিল। ডিমের আয়রন হিম পদ্ধতিতে থাকে বিধায় মানব শরীরের রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে দ্রুত সহায়তা করে। ডিম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে ও শরীরের ওজন কমায় এবং বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। চামড়া মসৃন রাখে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ডিম খেলে দৃষ্টি শক্তি এবং স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকে। ডিমের স্যাটাইটি ভ্যালু বেশি বিধায় ডিম খেলে পরিতৃপ্তি নিশ্চিত হওয়ার কারণে অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ কম হয়ে থাকে। একটি সম্পূর্ণ ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম মানসম্মত প্রোটিন, ৫ গ্রাম উন্নত ফ্যাটি এসিড, ৭০-৭৭ কিলোক্যালরী শক্তি, ১৭৫-২১০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল, ১০০-১৪০ মিলিগ্রাম কোলিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে।
মাংসের পুষ্টিগুণ : মাংস একটি উচ্চ আমিষের উৎস যেখানে সকল এমিনো এসিড বিদ্যমান। মাংস মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করে। বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধ করে। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়। প্রতি ১০০ গ্রাম মাংসে প্রায় ২২-২৬ গ্রাম মানসম্মত প্রোটিন, ৩-৪ গ্রাম উন্নত ফ্যাট, ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরী শক্তি, ৭০-৭৫ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল, ৫৫-৬০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে।
প্রাণিজ আমিষের উপযোগিতা : প্রাণিজ আমিষের (দুধ, ডিম ও মাংস) গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাণিজ আমিষ সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়। মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করে। বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধ করে। স্ট্রোক, হৃদরোগ, আথ্রাইটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। মানব দেহের ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। রক্তের ক্ষতিকর ট্রাইগ্লিসারাইডের উপস্থিতি হ্রাস করে। মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি বৃদ্ধি করে। সুস্থ সবল মেধাবী জাতি গঠনে সহায়তা করে।
দেশে বৈশ্বিক বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আপামর মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি উৎপাদন ও রপ্তানিতে এবং বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক প্রণীত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০৪১ সালে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে এবং বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান-২১০০ বাস্তবায়নে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানী আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং সুষ্ঠ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রাণিসম্পদ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, ২প্রাণিসম্পদ পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, প্রাণিসসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯৪৬৯৫২০১১, ই-মেইল : hmsalim@gmail.com